খুলনা শহরের অতীত ঐতিহ্যের কিছু কিছু বিলুপ্তপ্রায় নিদর্শন
এখনও যা টিকে আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বড়বাজারে অবস্থিত ইন্দ্রমোহন সুইটস। নানা
প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও শতবর্ষ অতিক্রম করে এখন দেড়শ বছরের পথে পা রাখতে চলেছে এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির
দোকান। এক প্রাচীনত্বের গন্ধ লেগে আছে দোকানের ছাদ, মেঝে আর দেয়ালের গায়ে। প্রায়
অন্ধকার, মলিন, জরাজীর্ণ একটি ঘর আপনার চোখে পুরনো খুলনার কিছুটা আবহ ও প্রতিচ্ছবি
হিসেবে ধরা দেবে।
যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৯০ সালে ইন্দ্রমোহন দে’র হাত ধরে।
অর্থাৎ খুলনা জেলা প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরই। খুলনার উত্তর অংশ অর্থাৎ ভৈরব তীর
সংলগ্ন এলাকাই হয়ে ওঠে তখন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। এটিই
খুলনা জেলার সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টির দোকান। হেলাতলা থেকে কালিবাড়ি রোড অভিমুখে
বড়বাজারের দিকে যেতেই দোকানটি চোখে পড়বে। না, সহজে হয়ত পড়বে না। কারণ একেবারেই
আড়ম্বর ও চাকচিক্যবিহীন এই দোকানের ভেতর ও বাহির। একটি ছোট হলুদ একতলা বাড়ির মাত্র
একটি ঘরই এই দোকানটি। ঢোকার দরজাটিও খুবই চিকন, দরজার ঠিক উপরেই ছোট করে লেখা আছে
‘ইন্দ্রমোহন সুইটস’।
ভেতরে ঢুকেই প্রথমে নজরে পড়বে একটি ছোট চৌকি আর তার পাশে
মাত্র চারটি পুরনো কাঠের হাতলযুক্ত চেয়ার। সাথে আশেপাশে একটু দৃষ্টি দিলেই টিমটিমে
আলোতে দেখতে পাবেন বড় কড়াইতে মিষ্টি আর দোকানের সামনের দিকে রাখা শেলফে সন্দেশ ও
কলাপাতা। দোকানের বিশেষত্ব হছে এখানে পিরিচের উপর কলাপাতায় মিষ্টি ও সন্দেশ
পরিবেশন করা হয়। আরও মজার ব্যাপার হল মিষ্টি খেতে হবে কিন্তু আপনাকে হাত দিয়েই,
কোন চামচ এখানে পাবেন না। এটাই এখানকার বৈশিষ্ট্য যা দোকানের জন্মলগ্ন থেকেই চলে
আসছে। এখানে মোট পাঁচ রকমের মিষ্টি পাওয়া যায়। রসগোল্লা, পানতুয়া, চমচম, দানাদার,
এবং সন্দেশ। মজার ব্যাপার হলো মিষ্টি এখানে কেজি হিসেবে বিক্রি হয় না বরং পিস
হিসেবে বিক্রি করে তারা তাদের আদি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। শুধুমাত্র সন্দেশ কেজি
হিসেবে বিক্রি করেন তারা।
তিন পুরুষ ধরে এই নিয়ম চলে আসছে। প্রতিষ্ঠাতা ইওন্দ্রমোহন
দে ১৯৭২ সালে মারা যাবার পূর্ব পর্যন্ত এই দোকানের হাল ধরে রেখেছিলেন। এরপর তার
ছেলে বেণীমাধব দায়িত্ব নেন। বর্তমানে বেণীমাধবের ছেলে সঞ্জয় দে দোকান পরিচালনা
করছেন। মাত্র তিনজন কারিগর নিয়েই দোকানটি পরিচালিত হচ্ছে। এবার দোকানের মিষ্টির
প্রসঙ্গে আসা যাক। দোকানের পরিবেশ আপনার হয়ত পছন্দ হবে না কিন্তু এখানকার মিষ্টির
প্রশংসা করতে আপনি বাধ্য। মিষ্টি তৈরীতে এখানে কোন প্রকার ভেজাল মেশানো হয় না।
খাঁটি দুধের সাথে বেকিং পাউডার আর ডিম দিয়েই এখানে মিষ্টি তৈরী হয় যা খেতে অত্যন্ত
নরম এবং সুস্বাদু। মিষ্টির গুণগত মান এখানে শুধু ভাল বললে ভুল হবে, অনেএএএক ভাল।
স্বাদের টানে আপনাকে পুনরায় ফিরে আসতে হবে এখানে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে
খুলনা সফরে আসেন এবং এই দোকানের মিষ্টি খেয়ে তার স্বাদের প্রশংসা করেন। তার সেই
ছবি বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই অসংখ্য মানুষ এখানকার
মিষ্টি খেতে আসেন। এখানে মিষ্টি প্রতিদিন তৈরী হয় তবে পরিমানে খুব বেশী নয় এবং
প্রতিদিনই সব বিক্রি হয়ে যায়। ঈদ ও পুজোয় এখানকার মিষ্টির চাহিদা আরো বেড়ে যায়। দোকানটি
আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহরের বুকে। চাইলে একবার ঘুরে আসতে পারেন এখান থেকে।